জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগ, ও বিএনপির মর্যাদার লড়াই

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ অন্য বছরের ন্যয় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কুড়িগ্রাম-২ আসন থেকে প্রার্থী হলে সব হিসাব-নিকাশ বদলে যাবে। তবে যেহেতু কুড়িগ্রাম সদর, রাজারহাট ও ফুলবাড়ী উপজেলা এবং কুড়িগ্রাম পৌরসভা নিয়ে কুড়িগ্রাম-২ আসন গঠিত ও কুড়িগ্রাম-২ আসনের বর্তমান এমপি বিরোধী দলের চিফ হুইপ ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম চৌধুরী আর জেলার হেডকোয়ার্টার হওয়ায় এ আসনটি অত্যন্ত মর্যাদার। প্রশাসন তথা জেলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এ আসনটি দখলে রাখার নিরন্তর চেষ্টা সবার। আগামী নির্বাচনে যে কোনো মূল্যে এ আসনটি দখলে রাখতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ বদ্ধপরিকর। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে জোরালোভাবে। সেই সঙ্গে তুলে ধরা হচ্ছে আওয়ামী লীগের উন্নয়নের ফিরিস্তি। অন্যথা আগামী নির্বাচনে এ আসনে জাতীয় পার্টি পড়তে পারে চ্যালেঞ্জের মুখে।

তাজুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৭৯ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত টানা এমপি নির্বাচিত হন এ আসনে। জিয়া ও এরশাদ আমলে তিনি প্রভাবশালী মন্ত্রীও ছিলেন। ওয়ান ইলেভেনের সময় তিনি ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর পিডিপিতে যোগ দেন। পরে জাপায় ফেরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বিএনপির টিকিট নিয়ে ২০০৮ সালে জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে হেরে যান। পরে এরশাদ আসনটি ছেড়ে দিলে উন্মুক্ত (জাপা, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পৃথকভাবে নির্বাচন করে) উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. জাফর আলীর কাছে শোচনীয়ভাবে হারেন। এরপর জাপায় ফিরে ২০১৪ সালে জাপার টিকিট নিয়ে মহাজোটের প্রার্থী হন। তাজুল ইসলাম চৌধুরী এমনিতেই নির্বাচনী এলাকায় কম আসেন। তার ওপর বেশ কয়েক মাস ধরে তিনি অসুস্থ। বন্যার সময় চিকিৎসার জন্য তিনি বিদেশে ছিলেন। জাতীয় পার্টির দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থার কারণে দলগতভাবে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। জোটগতভাবে জিততে হলেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় মনিটরিং এবং বিশেষ নজর ছাড়া সম্ভব হবে না। তারপরও তাজুল চৌধুরীর দাবি মহাজোট থাকলে জোটের প্রার্থী তিনি। কারণ বর্তমান সরকার প্রতিষ্ঠায় তার ছিল অন্য ভূমিকা। বিশেষ করে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসাবে কুড়িগ্রামে আগমনের ঘটনার পর থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কেউ আর তাজুল চৌধুরীর প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন না। তিনি সরকার প্রধানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিতি পান। আওয়ামী লীগের ছোট একটি গ্রুপ তার সঙ্গে লিয়াজোঁ করে চলছেন। সে কারণে পৌর নির্বাচন থেকে শুরু করে কয়েকটি নির্বাচনে প্রার্থী বদলের পেছনে তার হাত আছে এমন খবর চাউর হয়ে যায়।

জানা গেছে, জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক ভিত দুর্বল। জেলা ও উপজেলায় পাল্টাপাল্টি কমিটির কারণে সাংগঠনিক তৎপরতা কমে গেছে। এমপি পছন্দের লোকজনদের দিয়ে তার কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ ত্যাগী নেতাকর্মীদের। জাতীয় পার্টির বিকল্প প্রার্থী হিসেবে বাংলাদেশ বিমানের সাবেক পরিচালক মেজর (অব.) আবদুস সালামের নাম আলোচিত হচ্ছে। মেজর সালাম বিভিন্ন এলাকায় বিলবোর্ড টাঙিয়ে জনগণকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। মাঝে মধ্যে নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ করেন তিনি। মেজর সালাম জানিয়েছেন, তিনি মনোনয়নের ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী। নির্বাচন কমিশনের বিধিমালার কারণে সরকারি চাকরি থেকে অবসরের ৩ বছর পূর্ণ না হওয়ায় বিগত নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি। তবে এবার মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী তিনি। দলের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, তাজুল ইসলাম চৌধুরী মনোনয়ন না পেলে মেজর সালাম অথবা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নিজেই প্রার্থী হতে পারেন এই আসনে।

জাপার প্রার্থী হিসেবে সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পনির উদ্দিন আহমদের নাম শোনা যাচ্ছে। তিনি আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হলেও দীর্ঘদিন থেকে দলীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই। আর জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি মো. জাফর আলীর কাছে হেরে যাওয়ায় পনির উদ্দিন আহমেদ প্রয়োজনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে ধারণা করছেন তার অনুসারীরা। তবে এ প্রক্রিয়া সহজ হবে না বলে মনে করেন দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা।

আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে সাবেক এমপি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাফর আলীর নাম আলোচনার শীর্ষে রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে তার জনপ্রিয়তা এবং পরিচিতির মাপকাঠিতে তিনি এখনো অন্যদের থেকে এগিয়ে। এ ছাড়া সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) আমসাআ আমিন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আমিনুল ইসলাম মণ্ডল, সহ-সভাপতি চাষী করিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন, ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. হামিদুল হক খন্দকার, সাংগঠনিক সম্পাদক সাঈদ হাসান লোবান, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক আলহাজ রুহুল আমিন দুলাল, চলচ্চিত্র পরিচালক আবু সুফিয়ানেরও নাম শোনা যাচ্ছে। তারা সবাই দলের মনোনয়ন চাইবেন। আর এ লক্ষে তারা অনেকেই নিয়মিত গণসংযোগও করছেন। বিলবোর্ড ও পোস্টার দিয়ে পরিচিতি অর্জনের চেষ্টা করছেন। বিগত ২০১৪ সালের নির্বাচনে দলের জনপ্রিয় নেতা মো. জাফর আলী মনোনয়ন পেলেও মহাজোটের কারণে আসনটি জাপার প্রার্থী তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে ছেড়ে দিতে হয়। এবারেও জাপাকে আসনটি ছাড়তে হয় কীনা তা নিয়ে দলের ভেতর জোর গুঞ্জন রয়েছে। তবে দলের নেতাকর্মীরা এই আসনটি দাবি করছেন এবার। কারণ দলের প্রভাব, প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ এবং জেলার সার্বিক উন্নয়ন সমন্বয়ের ভূমিকা রাখতে হলে তাদের এ আসনটি চাই-চাই।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, জেলার ৪টি আসনে দলের এমপি নেই। তাই দলের নেতাকর্মীদের মনোবল সংহত রাখতে মো. জাফর আলীকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। আর এ সিদ্ধান্ত ছিল কেন্দ্রের। বিপুল ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক গণসংবর্ধনাও পেয়েছেন তিনি। দলমত নির্বিশেষে সবাই তাকে গ্রহণ করেছেন। একই সঙ্গে নির্বাচনী প্রস্তুতিও সেরে নিয়েছেন তিনি। তবে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার কারণে সংসদ নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন দেয়া হবে কীনা তা নিয়ে সংশয় কাটেনি। কুড়িগ্রামে বাস্তবায়িত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে জাফর আলীর অগ্রগণ্য ভূমিকা ও সর্বমহলে তার গ্রহণযোগ্যতার কারণে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে এগিয়ে রয়েছেন তিনি। মনোনয়ন নিশ্চিত হলে নির্বাচনের আগে তিনি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করতে পারেন। মো. জাফর আলী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ছাত্রজীবন থেকে আওয়ামী লীগের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছি। ৬ দফা কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। স্বাধীনতার পর প্রথম ২০০৯ সালের উপনির্বাচনে এ আসনটি আওয়ামী লীগকে উপহার দেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুড়িগ্রামে দৃশ্যমান যা উন্নয়ন হয়েছে তা আওয়ামী লীগের শাসনামলে হয়েছে। আমার হাত ধরে হয়েছে। সে বিবেচনায় দল আমাকে মনোনয়ন দিলে বিজয় ছিনিয়ে আনা সম্ভব।’

বিএনপির প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রীয় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভীর নাম সবার আগে উচ্চারিত হচ্ছে। ২০০৬ সালে বাতিল ঘোষিত নির্বাচনে তিনি এই আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। কুড়িগ্রাম শহরের চামড়াগোলা এলাকায় তার বাড়ি রয়েছে। বছরের বিভিন্ন সময়ে তিনি সেই বাড়িতে আসেন। রহুল কবীর রিজভী এই আসনে নির্বাচন করবেন কীনা তা স্পষ্ট না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে বন্যায় কয়েকদফা ত্রাণ বিতরণ করে নেতাকর্মী ও জনসাধারণের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছেন। কয়েকদিন আগে কুড়িগ্রামস্থ তার নিজ বাড়িতে স্থানীয় সাংবাদিকদের ডেকে সংবাদ সম্মেলন করেন।

এ ছাড়া এই আসনে প্রার্থী হিসেবে দলের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা, কুড়িগ্রাম পৌরসভার সাবেক মেয়র আবু বকর সিদ্দিক, সহ-সভাপতি শফিকুল ইসলাম বেবু ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদের নাম শোনা যাচ্ছে।

রিজভী আহমেদ নির্বাচন না করলে কে প্রার্থী হবেন তা পরিষ্কার না হলেও জনপ্রিয়তা ও মাঠে কর্মতৎপরতার দিক থেকে এগিয়ে রয়েছেন সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদ। দীর্ঘদিন ধরে মাঠ পর্যায়ে তিনি জনসংযোগ করছেন। সর্বত্র তার বিলবোর্ড ও পোস্টার। সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে একাধিক মামলা বিচারাধীন রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তবে হাল ছেড়ে দিতে নারাজ সাবেক মেয়র আবু বকর সিদ্দিক। তার গ্রুপের অনেক সতীর্থ তাকে ছেড়ে গেলেও যোগ্যতার মাপকাঠি ও ত্যাগের কারণে তিনি মনোনয়ন পাবেন বলে তার দাবি।

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা এবার কুড়িগ্রাম-১ আসনের পাশাপাশি কুড়িগ্রাম-২ আসনেও মনোনয়ন চাইবেন বলে নিশ্চিত করেছেন। সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদ ও সাইফুর রহমান রানার পক্ষে নেতাকর্মীরা ভেতরে ভেতরে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যাচ্ছেন। যদিও তারা দু’জনই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তাই এ নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধ চললেও মুখোমুখি কোনো আলোচনা হচ্ছে না। বিরোধের প্রকাশ্য রুপ নেই। এ ব্যাপারে সাইফুর রহমান রানা বলেন, ‘দুটি আসনেই মনোনয়ন চাইব। কেন্দ্র বিবেচনা করবে।’ অপরদিকে সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে জনসংযোগ করে পার্টির জনভিত্তি দাঁড় করিয়েছি। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা চান আমি নির্বাচন করি। তাই মনোনয়ন চাইব। কেন্দ্র যা ভালো মনে করবে, তা মেনে নেব।’

বামদলগুলোর মধ্যে বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা কমরেড অ্যাডভোকেট জাহেদুল হক মিলু প্রার্থী হতে পারেন। এই আসনে ইসলামী আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য ভোট রয়েছে। এই দল থেকে কে প্রার্থী হবেন তা এখনো নিশ্চিত হয়নি।

সূত্রঃ মানবকণ্ঠ

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর